যাত্রীদের সাথে বোয়ালমারী-বিআরটিসি বাসের কেন এই অমানবিকতা?
- বেলায়েত হুসাইন
- ২৬ জুন ২০২৩, ১৯:৩১, আপডেট: ২৬ জুন ২০২৩, ১৯:৫৪
প্দ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা থেকে ফরিদপুরের বোয়ারমারী উপজেলা শহর রুটে বিআরটিসি পরিবহনের কয়েকটি ট্রিপ নিয়মিত চলাচল করছে। রুটটিতে সরকারি এই পরিবহনের সার্ভিস চালু করতে অবশ্য সংশ্লিষ্টদের পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। জেলার বাস মালিক গ্রুপ চাইছিল না এখানে বিআরটিসি সেবা দিক। কারণ, এতে তাদের মালিকানাধীন যে পরিবহনগুলো আছে, সেগুলো থেকে প্রাপ্ত লাভের অংকটা কমে আসবে।
যেদিন বিআরটিসি বোয়ালমারী থেকে ঢাকার উদ্দেশে তাদের প্রথম ট্রিপটি ছাড়ে, ওটাই ভাঙ্গা পৌরসভা কার্যালয়ের সামনের সড়কে পৌঁছলে ফরিদপুর বাস মালিক গ্রুপের বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। এ নিয়ে সেই সময় দেশের প্রায় সব গণমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রকাশ করে। আমিও প্রথম আলোতে ‘বোয়ালমারীবাসীকে পরিবহনমালিকদের দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচান’ শিরোনামে চিঠিপত্র বিভাগে একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম এবং কর্তৃপক্ষ সেটা প্রকাশ করেছিল। মানে বোয়ালমারীতে বিআরটিসি বাস চালু হোক–পরোক্ষভাবে আমিও আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করেছি।
এখানে দুঃখের বিষয় হলো–সেই আমিই বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের অমানবিক আচরণের শিকার হলাম। ঘটনাটি গত ৭ জুন বৃহস্পতিবারের–সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় প্রতিদিনের মতো গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া কাউন্টার থেকে বোয়ালমারীর উদ্দেশে বিআরটিসির শেষ ট্রিপটি ছেড়ে যায়। ওই ট্রিপে আমিসহ প্রায় ৪০ জন যাত্রী। এদের মধ্যে একজন অতিবৃদ্ধ ও চার-পাঁচজন নারীও ছিলেন।
আমাদের বহনকারী বাসটি যথাসময়ের কয়েক মিনিট পরই স্ট্যান্ড ত্যাগ করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা ভাঙ্গার পরের স্টেশন ‘জয়বাংলা’য় পৌঁছে গেছি। সেখানে একজন যাত্রী নামবেন–এজন্য বাস থামানো হলো। যাত্রী নামার পর পাঁচ-সাত মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরও বাস ছাড়ছিল না। পরে ড্রাইভার-হেলপারসহ সংশ্লিষ্টদের তৎপরতায় বুঝতে পারলাম গাড়ির ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তারা ইঞ্জিনের ত্রুটি শনাক্তে ‘খুব ব্যস্ত’। এভাবে ১০-২০-৩০ মিনিট চলে যায় কিন্তু তারা যাত্রীদের কোনো আশার বাণী শোনায় না। তখন গরমে শিশু-নারী ও ওই অতিবৃদ্ধ লোকটিসহ সবার অবস্থা নাজুক। কারণ, এসি বাস হওয়ায় তাতে ফ্যান নেই এবং জানালা খোলারও ব্যব্স্থা নেই।
পরে একসময় বাসের হেলপার অস্পষ্টভাবে জানালেন, এই গাড়িতে বোয়ালমারী যাওয়া সম্ভব নয়। তখন তারা বিকল্প কিছুতে করে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছাবে বলে ভাবছেন। আর বিকল্প হলো–পিকআপ। এরইমধ্যে জয়বাংলার স্থানীয় এক পিকআপ-মালিকের সাথে দরদামের কথাও প্রায় পাঁকা করে ফেলেছেন। তখন আমিসহ আরো কয়েকজন প্রতিবাদ করি। আমাদের দাবি ছিল–আমরা এসি গাড়ির ভাড়া দিয়ে এসেছি। এখন যদি এসি গাড়ি না-ও পাওয়া যায়, অন্তত আমাদের জন্য সাধারণ একটি বাস ঠিক করা হোক। আমরা তাদের জয়বাংলার অদূরে মুকসুদপুর স্ট্যান্ডে থাকা স্বাধীন এক্সপ্রেস কিংবা বসুমতি বাস ঠিক করার প্রস্তাব দিই। শুধু তাই নয় রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে–আমি বিআরটিসির গুলিস্তান কাউন্টারে ফোন দিয়ে দ্রুত একটি ব্যব্স্থা করার অনুরোধ জানাই।
কাউন্টার থেকে বলা হলো–আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু একটু পর জানানো হয়–পিকআপেই যেতে হবে। নারীরা শুরুতে পিকআপে রাজি না হলেও পরে তাতে সম্মতি দেয়। কারণ, বোয়ালমারী থেকেও অনেকের শেষ গন্তব্য আরো দূরে। এজন্য দ্রুত অন্তত বোয়ালমারী পৌঁছাতে হবে। এ অবস্থায়ও আমি আমার দাবির ওপর অটল ছিলাম যে–আমাদের সাধারণ কোনো বাসে নিয়ে যাওয়া হোক। এ সময় কেউ আমার বিরোধিতা করছিলেন না; সমর্থন অল্প কয়েকজন করলেও চুপ ছিলেন বেশিরভাগ যাত্রী। বোঝাই যাচ্ছিল তারা আমার দাবিতে একমত। হঠাৎ এরই মধ্যে আমাদেরই এক যাত্রী আমার বিরোধিতা করলেন। পরে জানতে পারলাম–তিনি বোয়ালমারীর ছাত্রলীগের নেতা। এই রুটে বিআরটিসি বাস চালুতে তার ‘অবদান’ আছে।
ছাত্রলীগের ওই নেতা আমার সাথে শালীন আচরণ করলেন না। উচ্চবাচ্যের পাশাপাশি তিনি বোয়ালমারীর ছাত্রলীগের কী, তার আত্মীয়-স্বজনের সরকারি নানা পরিচয় দিতে থাকলেন। উদ্দেশ্য আমাকে একটু ‘ভয়’ দেখানো। আমি চুপ হয়ে গেলাম এবং শেষমেষ কোনো উপায় না দেখে সবার সাথে পিকআপে উঠে গেলাম। পিকআপ ছাড়ার পর জানতে পারলাম–ছাত্রলীগের ওই নেতা নাকি এখানের বিআরটিসি বাসের ব্যবসার সাথে যুক্ত (সত্য-মিথ্যা জানি না)। এজন্য যাত্রীদের পিকআপে নিয়ে যদি কিছু টাকা বাঁচানো যায়, তাহলে সেখান থেকে তার পকেটেও কিছু হিস্যা যাবে।
ঘটনাটি বলা আসলে উদ্দেশ্য নয়; বরং বলতে চাই–পরে আমাদের কিভাবে অন্তত ৪০ কিলোমিটার পথ পিকআপে নেয়া হলো, সেই ঘটনা। শিশু-বৃদ্ধ-নারীসহ এতগুলো যাত্রীর যে কী করুন অবস্থা তখন, তা নিজ চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল। এজন্য আমি বিআরটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে চাই–গাড়ির ইঞ্জিন বিকল কিংবা তাতে ত্রুটি হতেই পারে কিন্তু এরূপ পরিস্থিতিতে যাত্রীদের সাথে ন্যূনতম মানবিক আচরণ করা উচিত; সেদিনের মতো এমন অমানবিক আচরণ কখনোই নয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষক